বাংলাদেশে কৃষি ও শিল্পের আপেক্ষিত গুরুত্ব আলোচনা কর
বাংলাদেশে কৃষি ও শিল্পের আপেক্ষিত গুরুত্ব আলোচনা কর
উত্তর : আমাদের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অনস্বীকার্য-একথা নি:সন্দেহে বলা যায়। কারণ বর্তমানে দেশের জাতীয় আয়ের প্রায়
৩০% কৃষিতে উৎপন্ন হয় এবং কর্মরত মানুষের কমবেশি ৫৫% কৃষির সাথে জড়িত। এই তথ্য থেকে বুঝা যায় কৃষিখাতকে অবহেলা
করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি সুদৃঢ় করা সম্ভব নয় ।
একথা সত্য নয় যে প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোগত সুযোগ সৃষ্টি হলেই কৃষিতে উদ্বৃত্ত এবং বিনিয়োগের মাত্রা বেড়ে যাবে। বিভিন্ন
গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং গেবষকের কার্যক্রম থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জমি, শ্রম, মূলধন, ঋণ ইত্যাদি উপকরণের
সমন্বয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার উৎপাদন এবং পুন: উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কৃষির কাঠামোগত
উৎপাদনসমূহের মধ্যে শোষণমূলক বর্গা-মজুরী-ঋণ এই প্রচলিত ব্যবস্থায় ভূস্বামী এবং চাষাবাদকারী কৃষক এই উভয় দিক থেকে
উৎপাদনমুখী বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ফলে কৃষির অবকাঠামোগত সুযোগ হলেও বেশি হারে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি এবং উৎপাদনমুখী
বিনিয়োগে এর ব্যবহার স্তিমিত হয়ে যেতে পারে এবং সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়ায় স্তবিরতা আসতে পারে ।
নীচে উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি দেয়া হল
১. প্রথমত :
বাংলাদেশে শিল্প খাতের তুলনায় কৃষিখাতের প্রবৃদ্ধির হার কম। কৃষির দ্রুত উন্নয়ন করতে হলে এর কাঠামোগত
পরিবর্তন দরকার যা বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে করা অত্যন্ত কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ। এই প্রতিবন্ধকতা শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক কম বলা যায় ।
২. দ্বিতীয়ত :
কৃষির ব্যাপক উন্নতি করতে হলে বৃহদায়তন খামার ভিত্তিক চাষাবাদ পদ্ধতি চালু করতে হবে যা বাংলাদেশে
কোনক্রমেই সম্ভব নয় । অথচ শিল্পখাতে বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থা অনেকটা সহজে চালু করা সম্ভব।
৩. তৃতীয়ত :
কৃষি পণ্যের দ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যান্ত্রিকায়ন অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে বেশিরভাগ কৃষি খামারের
আয়তন ক্ষুদ্র হওয়ায় এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা প্রচুর। অথচ শিল্পখাতে আধুনিক কৃৎকৌশল সহজেই প্রয়োগ করা সম্ভব।
৪. চতুর্থত :
বন্যা, খরা, ঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি কারণে কৃষি উৎপাদন অনেকটা অনিশ্চিত। শিল্পক্ষেত্রে এই ধরনের
কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।
৫. পঞ্চমত : কৃষিক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপন্ন বিধি তাড়াতাড়ি কার্যকর হয়। কৃষির পুনর্গঠন করলে এর কার্যকারীতা
স্বল্পমেয়াদে প্রতিরোধ করা সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদে নয়। নতুন নতুন কৃৎকৌশলের আশ্রয় নিয়ে শিল্পক্ষেত্রে এই সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
৬. ষষ্ঠত :
বাংলাদেশে কৃষি জমির গঠন এবং অবস্থান অনুযায়ী কিছু প্রচলিত কৃষি পণ্য দ্রুত উৎপাদন করা কেবলমাত্র সম্ভব।
বিদেশী বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা স্থিতিস্থাপক নয়। আবার এদের মূল্য প্রায়ই উঠানামা করে এবং শিল্পজাত পণ্যের তুলনায়
দামও আপেক্ষিকভাবে কম। তাই বৈদেশিক বাণিজ্যের বেলায়ও কৃষি পণ্যের উপর এককভাবে নির্ভর করা উচিত নয়
৭. সপ্তমত :
দেশের বাড়তি জনসংখ্যা চাপ কৃষির উপর ক্রমাগত বাড়ছে। এতে গ্রামে বেকারত্ব, অর্ধবেকারত্ব এবং ছদ্মবেশি
বেকারত্ব ক্রমশ বাড়ছে। দ্রুত শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে কৃষিখাতের বাড়তি জনসংখ্যাকে শিল্পখাতে স্থানান্তর করতে পারলে দেশের অগ্রগতি তরান্বিত হবে।
৮. অষ্টমত :
বর্তমান আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শিল্পখাতের তুলনায় কৃষিখাতকে অতিরিক্ত অগ্রাধিকার দেয়া
হলে এর সামাজিক ব্যয় খুব বেশি হবে।
যে কোনো দেশের দ্রুত উন্নয়নের জন্য শিল্প এবং টারসিয়ারী খাতের উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ অনস্বীকার্য। কারণ দীর্ঘমেয়াদী
এবং টেকসই উন্নয়ন এর উপর মূলত: নির্ভর করে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এরূপ উন্নয়নের জন্য বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় কৃষিকে ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব, দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য নয়। তাই স্বল্পমেয়াদে কৃষির উপর নির্ভর করা সম্ভব, দীর্ঘমেয়াদের জন্য নয় ।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে কৃষির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। স্বল্পমেয়াদে কৃষিকে ভিত্তি করে উন্নয়ন কাজকর্মের সিংহভাগ পরিচালনা করে টার্নিং বিন্দু অতিক্রম করার পর শিল্পকে কেন্দ্র করেই উন্নয়ন নীতি পরিচালিত হওয়া উচিত।
আরো জানতে নিচে ক্লিক করুনঃ