বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির কারণ কি?
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির কারণ :-
উত্তর : ভূমিকা : মুদ্রাস্ফীতি একটি দেশে নানা কারণে সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ।
এদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হল মুদ্রাস্ফীতি । স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে দ্রব্য মূল্য ও জীবন যাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ।
১৯৬৯-৭০ সালে দ্রব্য মূল্য ১০০ টাকার ভিত্তিতে প্রায় প্রতিটি দ্রব্যের দাম ১৯/২০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এদেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা অবর্ণনীয়ভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ :
১. অর্থের যোগান বৃদ্ধি :
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ হল অর্থের যোগান বৃদ্ধি। ১৯৭১ সালে ১৭ই
ডিসেম্বর দেশে অর্থের সরবরাহ ছিল ৫৪৬.০২ কোটি টাকা।
নভেম্বর ২০০৪-এ দেশে অর্থের যোগানের পরিমাণ দাঁড়ায় ১,৩৯,০০১.৮ কোটি টাকা যা বর্তমানে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
২. উৎপাদন হ্রাস :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বাধীনতা উত্তরকালে উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে দেশে দ্রব্য সামগ্রির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় ।
এর ফলে মোট প্রচলিত অর্থের তুলনায় দ্রব্য সামগ্রির পরিমাণ কম হওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ।
৩. উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি :
মুদ্রাস্ফীতির ফলে উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
ফলে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রির দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিতে এর অশুভ প্রভাব দেখা দিয়েছে।
৪. জনসংখ্যা বৃদ্ধি :
বাংলাদেশে অতি দ্রুততার সাথে জনসংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে উৎপাদন বাড়েনি।
ফলে দ্রব্য সামগ্রির চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পায় ।
৫. বেতন বৃদ্ধি :
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের চাপে আমাদের দেশের শ্রমিকদের বেতন বিভিন্ন সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু উৎপাদন সে অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি। ফলে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
৬. সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি :
সাম্প্রতিক সময়ের সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পায় ।
ব্যয় দ্রব্য ও সেবার যোগান না বাড়ালে ঐ অবস্থায় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পায় তথা মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয় ।
৭. খাদ্য সমস্যা :
বাংলাদেশে প্রায়ই খাদ্য ঘাটতি হয়। তাই খাদ্য শস্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য দ্রব্যেরও দাম বৃদ্ধি পায় ।
৮. ঘাটতি অর্থসংস্থা :
উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য সরকারকে ঘাটতি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়। নোট ছাপিয়ে বা ঋণ গ্রহণ করে যখন সরকার প্রকল্প ব্যয় নির্বাহ করে, তখন দামস্তর বেড়ে যায়। ফলে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয় ।
৯. উদার ঋণনীতি :
বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদার ঋণনীতিও আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া,
অপ্রত্যাশিত জরুরী অবস্থা মোকাবেলা, ঘাটতি বাজেট পূরণ, রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় উৎস থেকে ক্রমান্বয়ে অধিক হারে ঋণগ্রহণ করছে। অনুৎপাদনশীল খাতে অধিক ঋণ গ্রহণের ফলেও মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হচ্ছে।
১০. শ্রমিক সংঘ কর্তৃক অযৌক্তিক মজুরী বৃদ্ধির দাবী :
অনেক সময় দেশে শক্তিশালী শ্রমিক সংঘের সদস্যদের প্রান্তিক উৎপাদন দক্ষতার চেয়ে আর্থিক মজুরী বেশি আদায়ে সক্ষম হতে পারে। এ অবস্থায় দ্রব্য ও সেবার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে
উৎপাদকগণ এই ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার সুযোগ গ্রহণ করে। তখন মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয় ।
১১. মজুতদার ও চোরা কারবার :
মজুতদারি ও চোরা কারবারীদের সমাজবিরোধী কার্যকলাপের ফলে নিজেদের হীন স্বার্থে দেশের অভ্যন্তরে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সাময়িক সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করছে।
১২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ :
বাংলাদেশে প্রতিবছর বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় লেগেই থাকে। ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করছে।
১৩. অতিরিক্ত পরোক্ষ কর :
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হল পরোক্ষ করের প্রভাব। দেশের মোট রাজস্বের ৮০ ভাগ পরোক্ষ কর হতে আসে। তাই পণ্য সামগ্রির মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ।
১৪. আমদানি নিয়ন্ত্রণ :
সংরক্ষণমূলক আমদানি নীতির কারণে আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় এদেশে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হচ্ছে।
১৫. পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা :
বাংলাদেশে অবকাঠামোগত অবস্থা মজবুত না হওয়ায় পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটেও উন্নত নয় । তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে সঠিক সময়ে দ্রব্য সামগ্রি পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পায় ।
১৬. আমদানিজাত দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি :
বাংলাদেশে আমদানি করা দ্রব্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঐ সকল দ্রব্যের মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করছে।
১৭. অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি :
আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হল অনুন্নয়ন ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি। এটাও মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করছে।
১৮. রপ্তানি বৃদ্ধি :
সাম্প্রতিক সময়ে এদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যের যোগান হ্রাস পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
১৯. দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি :
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরিবেশ বজায় থাকায় বাংলাদেশে দ্রব্য সামগ্রির উৎপাদন ব্যাহত হয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করছে।
২০. বর্তমান ইরাক বা মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি :
তৈল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত পরিবেশ বজায় থাকার কারণে তৈলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তার প্রভাব বিশ্বের প্রতিটি দেশে পড়েছে। বাংলাদেশেও দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
উপসংহার:-
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বিদ্যমান রয়েছে। তবে সরকারের সতর্ক মুদ্রানীতি ও নিয়ন্ত্রিত ঋণ সরবরাহ নীতির ফলে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির কারণ
আরো জানতে নিচে ভিজিট করুনঃ-